আম এদেশের মানুষের সর্বাধিক পছন্দনীয় ও জনপ্রিয় ফল। বর্তমানে দেশের ২৩টি জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। এদেশে জন্মানো জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু এই জাতটি। রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে জানা গেছে বিদেশিদের কাছেও জাতটির চাহিদা প্রচুর।সবকিছু বিবেচনায় এনে ২০১৬ সালে এই জাতটিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ‘The Geographical Indication (GI) Journal, No. 03’ এ জানুয়ারি ২০১৮ সালে প্রকাশ করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সব শর্ত পূরণ করার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আমটিকে নিবন্ধন সনদ প্রদানের জন্য পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে এদেশ অনেক সমৃদ্ধশালী হলেও দীর্ঘ সময় ধরে জিআই আইন না থাকায় এ দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মালিকানা সুরক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। এর পরই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য নিবন্ধনের পথ সুগম হয়। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হচ্ছে মেধাসম্পদের অন্যতম শাখা। কোন একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া, জলবায়ু, উৎপাদন পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট দেশের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি অনন্য গুণসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে বা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের বর্ণনা : চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম উৎকৃষ্ট জাতসমূহের মধ্যে একটি মধ্যম মৌসুমি এবং খুবই জনপ্রিয় বাণিজ্যিক জাত। ফল মাঝারি আকারের এবং অনেকটা ডিম্বাকৃতির। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ ফল গড়ে লম্বায় ৮.৬ সেমি., পাশে ৭.৫ সেমি., উচ্চতায় ৬.০ সেমি. এবং গড়ে ওজন ২৬৩.৯ গ্রাম হয়। পাকা ফলের ত্বকের রঙ সামান্য হলদে এবং শাঁসের রঙ হলুদাভ। শাঁস আঁশবিহীন, রসাল, গন্ধ আকর্ষণীয় ও বেশ মিষ্টি। গড় মিষ্টতা ২৩%। ফলের খোসা সামান্য মোটা ও শক্ত এবং আঁটি পাতলা। আঁটি গড়ে লম্বায় ৭.০ সেমি., পাশে ৪.০ সেমি., পুরুত্বে ২.০ সেমি. এবং গড় ওজনে ৪০.০ গ্রাম হয়ে থাকে। ফলের গড় আহারোপযোগী অংশ শতকরা ৬৭.২ ভাগ। জ্যৈষ্ঠ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আম পাকা শুরু করে। ফল পাড়ার পর পাকতে প্রায় ৫-৭ দিন সময় লাগে। ফলন খুবই ভালো তবে অনিয়মিত। ফল পরিপক্ব হতে (ফুল আসা থেকে) প্রায় চার মাস সময় লাগে। এ জাতের আমের পুরুষ ও উভলিঙ্গ ফুলের আনুপাতিক হার যথাক্রমে শতকরা ৯১.০ ও ৯.০ ভাগ। এই জাতটি দেশের সর্বত্র চাষাবাদ করা যেতে পারে।
অনন্য বৈশিষ্ট্য : চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আমের পাল্প দৃঢ় হওয়ায় পরিপক্ব আম বিভিন্ন ডিজাইন করে কেটে খাওয়া যায়। এ জাতের আমের আঁটিতে কোন আঁশ নেই এবং খেতে খুবই সুমিষ্ট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাটি কৃষি পরিবেশিক অঞ্চল ১১ এর উঁচু গঙ্গা নদী প্লাবন ভূমির অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালোমানের খিরসাপাত আম উৎপাদনকারী এলাকার জন্য মাটির পিএইচ ৬.৫-৭.৫ প্রয়োজন, যা উক্ত এলাকায় রয়েছে। এছাড়াও এই অঞ্চলের আবহাওয়া আমের গুণগতমানকে প্রভাবিত করে। সাধারণত দেখা যায়, আমগাছে মুকুল আসার সময়ে আবহাওয়া শুষ্ক ও ঠাণ্ডা এবং আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময়ে শুষ্ক ও গরম (২৮-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) থাকে ফলে আমের ফলন ও মান উভয়েই ভালো হয়। আমের মুকুল আসার সময় বা মুকুল বের হওয়ার পর বৃষ্টিপাত হলে বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে এবং আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময়ে বেশি বৃষ্টি হলে আমের গুণগতমান খারাপ হয়। এদেশের অন্য জেলাগুলোতে আম উৎপাদন হলেও মাটি ও আবহাওয়ার বিশেষ পার্থক্যের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অধিক পরিমাণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম উৎপাদন সম্ভব ।
উৎপাদনের পদ্ধতি : ভৌগোলিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত ও মিয়ানমারের মাঝখানে। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। এ দেশের বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২০০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশের গড় তাপমাত্র ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাংলাদেশের আবহাওয়া আম বাগান তৈরি ও আম উৎপাদনের উপযোগী। এ কারণে বাংলাদেশে আম বাগান গড়ে উঠেছে। আম বাগান তৈরির জন্য জমি প্রথমে চাষ দিয়ে ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয়। পরে নকশা অনুযায়ী জনপ্রিয় বর্গাকার পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় আমের চারা রোপণ করা হয়। বর্ষার শুরুতে অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আম গাছ রোপণের উপযুক্ত সময়। অতিরিক্ত বর্ষার সময় চারা রোপণ না করাই ভালো। রোপণের আগে ১ঢ১ঢ১ মিটার বিশিষ্ট গর্ত করে গর্তের ওপরের অর্ধেক মাটি এক পাশে এবং নিচের অর্ধেক মাটি অপর পাশে রাখতে হবে। গর্ত করার পর ১০-১৫ দিন গর্ত রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। গর্ত ভর্তি করার সময় ওপরের মাটির সাথে ১০ কেজি গোবর সার, ৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট ভালোভাবে মিশিয়ে, মিশ্রিত মাটি নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে দিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে। গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে চারিদিকে মাটি দিয়ে চাপ দিতে হবে। রোপণের পরে গাছে সেচ দিতে হবে এবং গাছটি একটি শক্ত খুঁটি দ্বারা বেঁধে দিতে হবে। চারাটির বয়স ২-৩ বছর হলে এবং চারার গোড়া থেকে নতুন ডালপালা গজালে তা কেটে ফেলতে হবে। গাছের দৈহিক বিকৃতি দেখা দিলে তা কেটে ফেলতে হবে।
পাতাকাটা উইভিল কচি পাতা কেটে ফেললে কার্বারিল গ্রুপের সেভিন ২ গ্রাম/লিটার অথবা সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের রিপকর্ড/কর্ট্ ১০ ইসি ১ মিলি/লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে দ্বারা আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। গাছটির বয়স ৪-৫ বছর হলে গাছে আম ধরাতে হবে। ফলন্ত গাছের পরগাছা, শুকনা ডাল, রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। বছরে দুইবার আম গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। বর্ষার শুরুতে একবার এবং বর্ষার পরে আর একবার সার প্রয়োগের পরে প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান করতে হবে। আম গাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হয়েছে কিন্তু ফুল ফোটেনি এবং আম মটর দানার মতো হলে এই দুই অবস্থায় সেচ প্রদান করতে হবে। আম গাছে প্রধান পোকার মধ্যে আমের ফলছিদ্রকারী এবং মাছি পোকা অন্যতম। এগুলোকে অনুমোদিত মাত্রার কীটনাশক প্রয়োগ করে এবং ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে দমন করা যায়। আমের রোগের মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পচা রোগ অন্যতম। এ রোগগুলোকে অনুমোদিত মাত্রার ছত্রাকনাশক এবং আম সংগ্রহের পর গরম পানিতে আম শোধনের মাধ্যমে দমন করা যায়।
খিরসাপাত আমের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক বেশি। মোট উৎপাদনের ২০-২৫ ভাগ আম এই জাতের এবং প্রতি বছরই বাড়ছে এই জাতের আমের বাগান। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে সুমিষ্ট এই জাতটি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাষিকে উত্তম কৃষি প্রযুক্তির আলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিরাপদ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এমনটিই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ড. মো. শরফ উদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আকবরপুর, মৌলভীবাজার, মোবা : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল :sorofu@yahoo.com